গল্প- খেলা যখন

খেলা যখন
-সুমিতা দাশগুপ্ত

 


আজ রবিবার। ভোরবেলাতেই জোর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে।এখন আকাশটা পরিষ্কার। নীল আকাশ বেয়ে সোনা রোদ ছড়িয়ে পড়ছে গাছগাছালির মাথায় মাথায়। চমৎকার দেখাচ্ছে বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির শোভা, শুধু ডাঃ দিব্যদ্যুতি রায়ের আজকের প্রাতর্ভ্রমণটাই মাটি হয়ে গেল, এই যা!

দোতলার বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে গেটের বাইরে সোজা কালো পিচের রাস্তাটার দিকে চেয়েছিলেন দিব্য। বৃষ্টিতে ঝরে পড়া কদমকেশর আর ছাতিমফুলের ছেঁড়া পাঁপড়িতে কালো পিচের রাস্তাটা যেন সেজে উঠেছে। শরৎকাল প্রায় এসে গেল ,তাও এই বছরে বৃষ্টিটা যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। মহালয়াটা যেন কবে? আরে আজকেই তো!! এবারে মহালয়াটা রবিবারে পড়ায়,আলাদা ছুটি মেলে নি বলেই বোধহয় তারিখটা ঠিক খেয়াল করতে পারছিলেন না তিনি।
অভিজাত এই শুনশান পাড়াটায়, শব্দদূষণের প্রকোপ যেমন নেই, তেমন‌ই নেই, ভোরবেলায় পাশের বাড়ির রেডিও থেকে ভেসে আসা মহালয়ার স্ত্রোত্রপাঠের মন ভালো করা‌ সুর।প্রতিবেশীরা সবাই কেমন যেন দূরে দূরে, প্রত্যেকেই নিজের মনে একলা থাকার অভ্যেস রপ্ত করে নিয়েছে।
একদা মধ্যবিত্ত দিব্য রায়, এখানে এসে পাড়া কালচারটা বড্ডো মিস্ করেন, অবশ্য কতক্ষণ‌ই বা বাড়িতে থাকেন তিনি ! সেই সাত সকালে বাড়ি থেকে বের হন, আর ফেরেন যখন তখন তো সন্ধ্যের চৌকাঠ পেরিয়ে, দিন র‌ওনা দিয়েছে রাত -গভীরে।

শহরের ব্যস্ততম ডাক্তারদের অন্যতম দিব্যদ্যুতি রায়ের, সারা সপ্তাহ দম ফেলবার ফুরসত থাকে না, কেবল রবিবার‌ আর ছুটিছাটার দিনগুলিতেই ঢিলেঢালা অবকাশে সময় কাটানোর সামান্য যা সুযোগ মেলে।
ছুটির দিনে ভরপেট জলখাবার খেয়ে,ফোনে
দুই একজন আত্মীয়স্বজনের খোঁজ খবর নেওয়া, বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে টুকটাক গপ্পোগাছা,ল্যাপটপে জমে থাকা ব্যক্তিগত মেইলগুলো চেক করে প্রয়োজনীয়‌ চিঠিচাপাটি চালাচালি, এইসব করেই সকালটা পার হয়ে যায়। এছাড়া কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রমের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছেন নিজেকে। না, কোনোও বাঁধাধরা রুটিনমাফিক ব্যাপার নয়। স্বেচ্ছায় একেক দিন গিয়ে ঘুরে আসেন কয়েকটি ওল্ড এজ হোম থেকে। সাধারণ হেলথ চেক আপ, কিছুক্ষণ বৃদ্ধমানুষগুলির সঙ্গে বসে, সুখ দুঃখের গল্প করা, কারো কারো ব্যক্তিগত সমস্যায় কিছু পরামর্শ দেওয়া, অথবা সম্ভব হলে একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। এইসব‌ই আর কী! এইটুকতেই কতো যে খুশি হয়ে যান একাকী নিঃসঙ্গ মানুষগুলো, সেই হাসিখুশি মুখগুলো দেখে দিব্যর মনটাও বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। না, কোন‌ও স্বার্থ নয়, কিছুটা সামাজিক দায়িত্ববোধে এই কাজগুলো করে থাকেন তিনি, ঠিক তাঁর নিজের বাবার মতোই। ছেলেবেলা থেকেই দেখে এসেছেন তাঁর‌ বাবা, রবিবার সকালটায় বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন এলাকার গরীবগুরবো মানুষগুলোর। দিব্য‌ও বোধহয়, উত্তরাধিকার সূত্রেই এই দায়িত্ববোধটুকু বাবার কাছ থেকে লাভ করেছেন।

দুপুরে পছন্দের খাওয়া দাওয়া, কোন‌ও দিন দিবানিদ্রা, কখন‌ও বা গপ্পের ব‌ই— সন্ধ্যাবেলায় কোনোদিন গ্রুপ থিয়েটার, আবৃত্তির আসর, অথবা চিত্রপ্রদর্শনী। ব্যস্, এইভাবেই কেটে যায় অকৃতদার দিব্য রায়ের একলা জীবন। গতানুগতিকতায় আবদ্ধ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনটা রবিঠাকুরের ভাষায়—- “যেন ঘোলা জলের ডোবা,না সেখানে হাঙর কুমিরের নিমন্ত্রণ,না রাজহাঁসের।”

পঞ্চাশের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো,সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী দিব্যদ্যুতি রায়, আজ‌ও সুদর্শন।বয়স বিশেষ একটা ছাপ ফেলতে পারে নি, কেবল একমাথা চুলের সামনেটায়,একগুচ্ছ কাশফুল অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর রেখে যায়।

দিব্যর সংসারের সম্পূর্ণ দায়িত্বভার বিভামাসিমার উপরে। না, রক্তের কোন‌ও সম্পর্ক‌ নেই তাঁর সঙ্গে, কিছুটা আকস্মিক ভাবেই বিচিত্র ঘটনা প্রবাহের জেরে দুটি মানুষ আজ পরষ্পরের সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দিব্যর পরিচিত একটি বৃদ্ধাবাসে, দায় এড়িয়ে ফেলে রেখে যাওয়া, অসহায়,নিঃসন্তান, ভাগ্যতাড়িতা অভিজাত মহিলাটিকে,দিব্য‌ই একদিন উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে এনে তুলেছিলেন। দয়া নয়, মানবিকতা! আশ্রিতা হিসেবে নয়, সসম্মানে মর্যাদা সহকারে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন এই সংসারে।

ব্যাপারটা ঘটেছিল খুব আকস্মিকভাবে।সেদিন দিব্যর ওখানে যাবার কথা ছিল না তবু ঘটনাচক্রে আচমকাই গিয়ে পড়েছিলেন ওই হোমটিতে।
সেইদিন‌ই আবার হোমের কর্তৃপক্ষ,বিভাদেবীর হাতে ঘরছাড়ার নোটিস ধরিয়ে দিয়েছিলো। গত দুমাস ধরে নাকি প্রতিশ্রুতিমাফিক টাকাপয়সা জমা পড়ছিলো না। তথাকথিত আত্মীয়রা, যারা নাকি, কী সব কাগজপত্তরে, স‌ইসাবুদ করিয়ে তাঁর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করার এবং নিয়মিত তাঁর মাসের টাকা পয়সা,তাঁর হাতে পৌঁছে দিয়ে যাবার কড়ারে, ব্যাঙ্কের সমস্ত কাগজপত্র হাতিয়ে নিয়ে , এবং সুযোগ বুঝে তাঁকে ঘরছাড়া করে এই বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছে দিয়েছিল, সম্প্রতি তারা সবাই নাকি “আনরিচেবল!”
নিজের সন্তান ছিল না বলে, বিভাদেবী যাদের সন্তানতুল্য জ্ঞান করতেন, বুকে করে মানুষ করলেন, স্বামী মারা যাবার পর, তাদের এই রূপান্তর তাঁর দূরতম কল্পনাতেও ছিল না।
লোক পাঠিয়ে খবরাখবর নিতে গিয়ে জানা গেছে, সাবেকী বসতভিটা ভেঙে, ফ্ল্যাট উঠছে। প্রোমোটারের কাছ থেকে পাওনাগন্ডা বুঝে নিয়ে শরিকরা সবাই হাওয়া হয়ে গেছে।

অকূল পাথারে পড়ে গিয়েছিলেন বিভাদেবী। দিব্য রায় সেদিন বুঝি বা ঈশ্বর প্রেরিত দূত হয়ে দেখা দিয়েছিলেন,তাঁর সামনে। ডুবে যাবার আগে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতোই দিব্যর হাত দুখানি ধরে বিভাদেবী,অশ্রুসজল চোখে, তাঁকেই কোন‌ও অনাথ আশ্রমে
যা‌ হয় একটা বন্দোবস্ত করে দেবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ন‌ইলে যে রাস্তায় দাঁড়ানো ছাড়া উপায় ছিলো না।
অন্য কেউ হলে হয়তো বা দায় এড়িয়ে চলে যেতো, কিন্তু দিব্য পারেন নি। কী দেখেছিলেন সেই বিপন্ন মুখে কে জানে! হয়তো বা কতোকাল আগে লোকান্তরিতা মায়ের ছায়া!
সেই মুহূর্তে কী করবেন ঠিক করতে না পেরে, হোমের বাকি বকেয়া মিটিয়ে আর‌ও ক’টা দিন সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। বড়ো কোন‌ও সিদ্ধান্ত নেবার আগে ঠান্ডা মাথায় ভাবনা চিন্তা, বিচার বিবেচনা করার প্রয়োজন। বিপাকে পড়েছেন বলেই একদা সম্পন্ন ঘরের মাতৃসমা মহিলাটিকে কী করে অনাথ আশ্রমে, প্রায় পরিচারিকা হতে, রেখে দিয়ে আসা যেতে পারতো!
শেষটায় অনেক ভেবে দিব্য তাঁকে এই বাড়িতেই নিয়ে আসার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন।
প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্না মহিলাটিকে অবশ্য সহজে রাজি করানো যায় নি। অনেক কষ্টে অবশেষে দিব্য তাঁকে বোঝাতে পেরেছিলেন, যে প্রয়োজনটা কেবল তাঁর একার নয়, পারষ্পরিক। বস্তুত কয়েকমাস আগে প্রবল ভাইরাল ফিভারে আক্রান্ত দিব্যকে, মধ্যরাতে একগ্লাস জল এগিয়ে দেবার মতো একজন‌ও কেউ ছিলো না। সেই থেকে, সত্যিই ইদানীং দিব্যর মনে, মাঝে মাঝে একটা বিপন্নতাবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিলো।
দিব্য, বিভাদেবীকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিল, লোকে যদি সন্তান দত্তক নিতে পারে ,তাহলে মা’কেই বা কেন নয়!
অনন্যোপায় বিভাদেবী প্রথমটায় সাময়িকভাবে থাকতে রাজি হয়েছিলেন বিকল্প ব্যবস্থা হলেই চলে যাবেন-এই শর্তে, কিন্তু পরবর্তীকালে,এই স্বজনহীন ছন্নছাড়া বিশৃঙ্খল সংসারে, দিশাহারা দিব্যকে একা ফেলে রেখে চলে যেতে পারেন নি। তিনি থাকলে, সময়ে ভাতের থালাটুকু তো অন্তত মিলবে দিব্যর। আবার‌ও সেই মায়া!!
বলাই বাহুল্য , নিকট‌ আত্মীয়ের দল, যাঁরা কিনা নিজেদের দরকার ছাড়া, কখনো উঁকি দিতেও আসতেন না, তাঁদের কপালে বড়ো বড়ো চিন্তার ভাঁজ পড়েছিলো বৈকি, কিন্তু তাতে বিভাদেবীর কিচ্ছু এসে যায় নি । অতঃপর,সন্তানসম মানুষটির এই সংসারেই তিনি থেকে গেলেন দিব্যর মাসিমা হয়ে।
‌‌ এই বাড়িতে আসার পর তিনি হাফডজন চাকর-বাকর, মালি, ড্রাইভারের হাতে থাকা টালমাটাল সংসারটির হাল ধরেছিলেন শক্ত হাতে। অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী, মৃদুভাষী মহিলাটির নির্দেশ‌ অমান্য করার সাহস কারোর হয় না, এমন কী খাওয়া দাওয়া, শরীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে দিব্যকেও আজকাল তাঁর নির্দেশ মেনেই চলতে হয়।

বিভাদেবীর সব চাইতে ভালো ব্যাপার হলো, দিব্যর ব্যক্তিগত পরিসরে, তিনি কোন‌ও দিন মাথা গলান না, নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে অকারণ কৌতূহল প্রকাশ করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ।
মোটকথা বিভাদেবী আসার পর, দিব্যর ছন্নছাড়া সংসারটা আবার মনের খুশিতে ঘরোয়া কাজকর্মের খুটখাট আর বাসনকোসনের ঠুনঠান, সুরেলা আওয়াজে মেতে ওঠে। স্রেফ ইট-কাঠ কংক্রিট দিয়ে তৈরী দিব্যর বাড়িখানা, এখন বেশ গেরস্তর ঘর-দুয়ার হয়ে শোভা পায়!
ইতিমধ্যে দিব্য আর‌ও একটা কাজ‌ করে ফেলেছেন। তাঁর প্রাক্তন রুগী, শহরের এক নামজাদা দুঁদে উকিল এবং পুলিশের উচ্চপদস্থ কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সাহায্যে, বিভাদেবীর সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াটি চালু করে দিয়েছেন। না শুধুই অর্থের জন্য নয়, ন্যায়বিচার‌ পাবার অধিকার তো সকলের‌ই আছে। আর‌ও একটা কারণে দিব্য‌ এই পদক্ষেপটি নেওয়া জরুরী মনে করেছিলেন, নিজেকে আশ্রিতা ভাবার কুন্ঠাবোধ থেকে বিভাদেবীকে মুক্তি দেওয়া।

এখন বেলা প্রায় এগারোটা। সকালের বৃষ্টিটার পর চড়া রোদ উঠেছে। বাগানের কোণের শিউলি গাছটা থেকে ঝরা শিউলির মৃদু সুবাস এখন‌ও হাওয়ায় ভাসছে।
শিউলি ফুল মায়ের খুব প্রিয় ছিলো। মাসিমা সেই কথা জানতে পেরে রোজ সকালে কাঁচের ডিশে‌ করে একরাশ শিউলি ফুল মায়ের ছবির সামনে রেখে আসেন। দিব্যর মনটা ভরে যায়।

জীবনটা সত্যিই বড়ো অদ্ভুত।
কে যে কোন অন্তরালে বসে তার অদৃশ্য
অঙ্গুলি হেলনে এই বৃহৎ সংসারের নাটমঞ্চ পরিচালনা করেন ,ভেবেও কূল তল পাওয়া যায় না।
জীবনে একটু থিতু হতে না হতেই‌, দিব্যকে এই বিশাল পৃথিবীতে একা করে দিয়ে বাবা‌,মা দুজনেই চলে গেল, তারপরেও যাকে আঁকড়ে ধরে, নতুন করে জীবন সাজাতে চেয়েছিলেন
সে-ও তো—ভাবনাটা মনের চৌকাঠে এসে দাঁড়াতেই, সজোরে এঁটে বন্ধ করে দিলেন দরজাটা।
‘কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’
চটপট ঘরে এসে বিছানায় বসে ল্যাপটপটা খুলে বসলেন।
ও বাবা! কতো মেইল এসে পড়ে আছে। সব‌ই সেই অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসা। সপ্তাহ পার হয়ে গেল,এখন‌ও লোকের এতো উচ্ছ্বাস!
সম্প্রতি বিনা চিকিৎসায় মরতে বসা হতদরিদ্র একটি শিশুর খুব জটিল হার্ট অপারেশন করেছিলেন তিনি এবং তাঁর সহযোগিরা। সাফল্যের আশা প্রায় ছিলোই না। কতোটা তাঁদের হাতযশ আর কতোটা ঈশ্বরের কৃপা সে বিষয়ে তিনি নিজেই আজ‌ও নিশ্চিত নন। সংবাদপত্রে খবরটা ফলাও করে বেরিয়েছিল। দুই একটা কাগজ আবার তাঁর এবং সহযোগীদের ছবিও ছেপে দিয়েছে। ব্যস্ সারা শহর জুড়ে হৈ চৈ। উফফ্ ,বড়োই এমব্যারাসিং। এতো হৈ চৈ করার মতো কিছু আছে বলে দিব্য মনে করেন না। দায়িত্ববোধ সম্পন্ন যে কোন‌ও ডাক্তারকেই তো,কখন‌ও‌ না কখন‌ও প্রাণ বাঁচানোর এই লড়াইটা লড়তেই হয়!
হ্যাঁ এক্ষেত্রে লড়াইটা খুব কঠিন ছিলো সন্দেহ নেই, তবু…।
মেইলগুলো পরপর চেক করছিলেন। দরকারি কিছু মিস্ হয়ে না যায়। নজর বোলাতে বোলাতে আচমকা এক জায়গায় এসে দিব্যর নজরটা আটকে গেল। বিস্মিত হয়ে দেখলেন, লন্ডন থেকে জনৈক মিসেস ব্রাউন,একখানা দীর্ঘ মেইল পাঠিয়েছেন। আশ্চর্য ব্যাপার! কে এই মিসেস ব্রাউন! এই নামে কাউকে চেনেন বলে তো মনে পড়ে না, তা-ও আবার ঝরঝরে বাংলায়,এবং নির্ভুল বানানে!
কৌতূহলী হয়ে চিঠিতে মন দিলেন দিব্য।

“শ্রদ্ধাষ্পদেষু,
আপনি আমাকে চিনবেন না,আমি হলেম ঝুমকোলতা,আমার মায়ের নাম কলমীলতা,ওরফে কমলিনী।”
— কী –ই-ই। প্রচন্ড জোরে একখানা ধাক্কা লাগলো বুকের মধ্যে।
ঠাস্ করে বন্ধ করে দিলেন ল্যাপটপটা। ছটফটিয়ে উঠে আবার বেরিয়ে এলেন বাইরে। কে এই মিসেস ব্রাউন! তাঁর মুখে এইসব‌ নাম ! কী করে –কোথা থেকে? আশ্চর্য!! যে কথা কেউ জানে না,যা‌ একান্ত‌ই তাঁর মনের মণিকোঠায় তুলে রাখা নিজস্ব সম্পদ, সাত রাজার ধন এক মানিক, সেকথা অন্য কেউ জানলো কি করে!
উদগ্র কৌতূহল,তাঁকে বাধ্য‌ করলো আবার ঘরে ফিরে এসে ল‌্যা‌পটপখানা খুলে বসতে।

” জানি এইটুকু পড়েই আপনি টানটান, হয়ে উঠে বসেছেন। আরে দাঁড়ান,
আগেই অতোটা উত্তেজিত হবেন না প্লিজ। আপনাকে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়,বরং বলতে পারেন, অচেনা কারো লেখা চিঠিখানা আপনি যাতে এড়িয়ে না যান, একটু মন দিয়ে আমার সমস্যাটার কথা শোনেন, সেইজন্য শুরুতেই এই ধাক্কাটা দিতে চেয়েছিলাম।আমার যে আপনার সাহায্যের খুব প্রয়োজন‌! সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
এবারে আসল কথায় আসি।
শুনুন বলেছি বটে আমার মা, আসলে তিনি আমার মাতৃসমা পিসিমণি, আর আমি, তাঁর জীবনে ‘কোন‌ওদিন না আসা মেয়ে’, —যাকে বলে মানসকন্যা। আমার আসল নাম, স্পৃহা।
আপনার বর্তমান অবস্থান, অথবা পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষ কিছুই আমার জানা নেই, কিন্তু এই দুনিয়ায় আর কাউকেও খুঁজে পেলাম না যিনি এই বিপদ থেকে আমার পিসিমণিকে উদ্ধার করতে পারেন। আমার পিসিমণির খুব বিপদ।
এককালে এই পৃথিবীতে আপনিই তো ছিলেন তাঁর একমাত্র আপনজন! তাঁর নিজের লোকেরা যে থেকেও নেই ,সেকথা আপনার চাইতে আর কে বেশি ভালো জানে!
ভাবছেন হয়তো আমি নিজেই কেন এগিয়ে যাচ্ছি না।আসলে এই মুহূর্তে আমি একেবারে নিরুপায়।‌ একে আমি লন্ডনবাসী,তার উপরে গত সপ্তাহে একটি কন্যা সন্তানের জননী হয়েছি। আশাকরি পরিস্থিতিটা বোঝাতে পারলাম।
আপনি হয়তো জানেন না, আপনাকে হারিয়ে পিসিমণি, সারাটা জীবন, সংসারে থেকেও সংসারের বাইরে নিজের তৈরী করা জগতেই বসবাস করে গেলেন। সেই জগতে ‘ফুল নেই পাখি ডাকে না, ভরা গলায় নাম ধরে ডাকে না কেউ’…তিনি আজ‌ও মনে মনে আপনার‌ই পথ চেয়ে বসে আছেন।
মাঝের এতোগুলো বছর তাঁর কাছে, অস্তিত্বহীন। না,তিনি পাগল নন, কেবল গভীর বিতৃষ্ণায়,পরিবারের মানুষগুলিকে নিজের জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। তারা যেন থেকেও নেই, পরাবাস্তবের,ছায়া মানব-মানবী। পিসিমণি তাঁর জীবনে একা। তাঁর দৈনন্দিন একলা যাপনে আজ‌ও আপনি, হ্যাঁ একমাত্র আপনিই তার সঙ্গী। আমাকেও অবশ্য একটু ঠাঁই দিয়েছিলেন, কিন্তু এখন আমিও তো দূরের মানুষ হয়ে গেছি।

খুব ছোটবেলায়,অভিভাবকদের নজর এড়িয়ে টলোমলো পায়ে একদিন তাঁর ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম। জানলার শিক ধরে, পথের পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির আঁচল ধরে টানতেই চমকে পিছন ফিরে, অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে র‌ইলেন বেশ কিছুক্ষণ, তারপর সেই যে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, সারাজীবনেও আর ছাড়লেন না। সেই থেকে আমিই তাঁর ঝুমকোলতা, এই পরিবারে একমাত্র আপনজন।
একটু বড়ো হতে না হতেই ,তাঁর জীবনের সব কাহিনী আমার জানা হয়ে গেল, কিছুটা তাঁর টুকরো টুকরো কথায়, বেশির ভাগটাই, এই বাড়ির বহু পুরনো চাকর গোবিন্দদাদার কাছে, আর বাকিটা বাড়ির বাতাবরণে টাঙানো, ঢাকঢাক গুড়গুড়ের দরপরদার আড়াল থেকে উঁকিমারা গল্পের রেশ ধরে।
আপনি তখন মেডিক্যাল কলেজে সিনিয়ার হাউজস্টাফ, আর পিসিমণি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষ। ফেষ্টে আলাপ।প্রথম‌ দর্শনেই মফস্বলের সহজ সরল,নরম স্বভাবের মেয়েটি নজর কাড়লো। তার, পিঠের প’রে দোলানো লম্বা বেণী আর দীঘল চোখের মায়ায় প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হলেন, তারপর ভেসে গেলেন তার আবৃত্তির টানে। আপনি নিজেও যে একজন দক্ষ আবৃত্তিকার! দিনের পরে দিন যায়। পরিচয় দানা বাঁধে, ঘন হয়। আপনারা জুটি বেঁধে আবৃত্তি করেন।জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভাসা যুগল আবৃত্তির টানে টাপুর টুপুর শব্দ ঝরে, আপনাদের নিত্যকার জীবনেও। অবশেষে ঠিক সেইটাই হলো যেটা হ‌ওয়া স্বাভাবিক ছিলো। আপনাদের প্রেম ধীরে ধীরে দানা বাঁধলো।
ওদিক পাশ করেই আপনার চাকরী জুটে গেছে, পিসিমণি ফাইন্যাল দেবে।
স্বপ্নের দিন গোনা শুরু। নিরন্তর ‌আঁকা হতে থাকে ভবিষ্যত সংসারের মনোরম ছবি। আপাদমস্তক রোম্যান্টিক আপনি পিসিমণির নতুন নাম দিলেন কলমীলতা,আর ভবিষ্যতের কন্যার নাম হলো ঝুমকোলতা! সুখের স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে দুজনকে।
এইসব খবর তো আর চাপা থাকে না।দাবানলের আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লো, পৌঁছে গেল ঠাকুরদার কানে। পিসিমণিকে শুধু যে গৃহবন্দী করে ফেলা হলো তাই-ই নয়, অবিলম্বে ঘটক লাগিয়ে ,পালটি ঘরের পাত্র খোঁজা শুরু হলো। অচিরেই বংশমর্যাদায় মানানস‌ই, অথচ,বয়স, শিক্ষা, আচার-ব্যবহার, রুচি, পছন্দে সম্পূর্ণ বেমানান এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে পাকাও হয়ে গেল। এই বিষয়ে কেউ টুঁ শব্দটিও করলে না। কে করবে?পিসিমণির মা ছিলো না যে‌, তাছাড়া তখন বাকিরা সবাই পিসিমণিকে তড়িঘড়ি পাত্রস্থ করতে পারলেই বাঁচে। কখন কে এসে বাগড়া দেয়! ওদিকে পাত্রপক্ষরা আবার বেজায় ‘উচ্চঘর, কংসরাজের বংশধর!’ সোজা কথা !

মরিয়া পিসিমণি গোপনে গৃহত্যাগের পরিকল্পনা করে, আপনাকে নাকি একখানা চিঠিও পাঠিয়েছিল, বিয়ের আগের রাতে পিছন দরজা দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থাও পাকা , কিন্তু পৃথিবীতে গুপ্তচরের তো আর অভাব নেই! আপনার আর পৃথ্বীরাজ হ‌ওয়া হলো না,পরদিন ভোরে গ্রামবাসীরা নাকি অর্ধমৃত অবস্থায় আপনাকে হাইওয়ের পাশ থেকে উদ্ধার করেছিলো।
‌ কয়েক মাস বাদে সুস্থ হবার পর,আপনি স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে পড়তে চলে গিয়েছিলেন, ব্যস্ এইটুকু খবর‌ই জানা গিয়েছিলো,বাকিটা আমাদের কারো জানা নেই।

পিসিমণির বিয়েটা কিন্তু হয় নি। একমুঠো স্লিপিং পিল খেয়ে চিরশান্তির দেশে পাড়ি দেবার চেষ্টায় ছিলো বেচারি, ঈশ্বর সেইটুকু কৃপাও করেন নি তাঁকে।

এবার আসি পরবর্তী অধ্যায়ে‌।
বড়ো হয়ে পড়াশুনা শিখে আমি অধ্যাপনার জগতে পা রাখলাম। বাধা এসেছিলো বৈকি।তবে নখদন্তহীন শার্দুলরা তখন হীনবল।

অধ্যাপনা করি, নিজের কাছেই মাঝে মাঝে লাইব্রেরী যেতে হয়।
একদিন বৃটিশ কাউন্সিলে,ঘটনাচক্রে জনের সঙ্গে আমার আলাপ। বৃটিশ হাইকমিশনের, কী একটা কাজে, সে এদেশে এসেছিলো। ইতিহাসের ছাত্রী জেনে উৎসাহিত‌ জন নিজের থেকে এসে আলাপ করলে। জব চার্নকের শহরের প্রেমে মুগ্ধ বৃটিশ যুবকটি সারা শহর চষে বেড়াতে চায়। কে জানে কেন আমাকেই তার মুরুব্বি ঠাওরালে। কয়েকটা মাস কেটে গেল, কলকাতা শহরের প্রেমে মুগ্ধ ইংরেজ যুবকটির শহরবাসিনীর প্রেমে পড়তেও দেরী হলো না। বাকিটা,বুঝতেই পারছেন, অলমিতি বিস্তরেন।
না, পিসিমণির মতো ভুল আমি করিনি,বাড়িতে সবকিছু জানাজানি হয়ে যাবার আগেই রেজিষ্ট্রি বিয়েটা সেরে ফেলেছিলাম। তা সত্ত্বেও কম ঝামেলা পোয়াতে হয় নি, তবে দূতাবাসের ক্ষমতা তো জানেন‌ই, আটকে দেবার আগেই তারা আমায় উদ্ধার করে নিয়েছিল।
অসহায় পিসিমণিকে ছেড়ে চলে আসতে বুকটা ভেঙে যাচ্ছিলো। সেইদিন কিন্তু পিসিমণি তাঁর নিজস্ব ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে এসেছিলো। কে জানে, হয়তো বা বহুকাল আগে ঘটে যাওয়া নাটকের পুনরাভিনয় তাঁকে বাস্তবের শক্ত জমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে, চোখের জল মুছিয়ে, বলেছিলো —“যা পালা”।
উপহার দিয়েছিলো তাঁর একমাত্র সম্বল আপনার দেওয়া সঞ্চয়িতাখানা।

চলে আসার আগে খুব গোপনে গোবিন্দদাদাকে একখানা মোবাইল‌ কিনে দিয়ে এসেছিলাম। কেবল মা‌-ই, ব্যাপারটা জানতো। খবরাখবর সব তার মাধ্যমেই দেয়া নেয়া চলে। এইভাবেই দিন যায়। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত।
দিন পনেরো আগে মা সঙ্গোপনে গোবিন্দদাকে একখানা গোপন ষড়যন্ত্রের খবর দেয়।
আমাদের পেল্লায় বাড়িটা নাকি হাত বদল হতে চলেছে, হোটেল হবে। বিশাল লোভনীয় অফার, কেবল গোল বেধেছে পিসিমণিকে নিয়ে। কে তার দায়িত্ব নেয়!
উকিল বন্ধু পরামর্শ দিয়েছে,পিসিমণিকে পাগলা গারদে পাঠাতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান। একখানা সার্টিফিকেট জোগাড়ের ওয়াস্তা , তাহলেই কেল্লা ফতে! পিসিমণির দায়‌ও নিতে হয় না,ওদিকে তার ভাগের সম্পত্তিও নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নেওয়া যায়। পুজোর পরেই নাকি সব ফর্মালিটিস সেরে ফেলা হবে!
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিলো, সমস্ত চেনা জানা সোর্স কাজে লাগিয়েও যখন কোন‌ও সুরাহা করে উঠতে পারছিলাম না ,তখন‌ স্বয়ং ঈশ্বর‌ই যেন পথ দেখালেন। গোবিন্দদা কাগজে আপনার ছবি দেখে চিনতে পেরেছে!
আমার স্বামী জন আপনার মেইলিং এ্যাড্রেসটা জোগাড় করেছে। আপনার বর্তমান পারিবারিক পরিস্থিতি আমার জানা নেই,তবু আপনার কাছে আমি করজোড়ে মিনতি করছি ,আপনি আমার পিসিমণিকে পাগলা গারদে যাওয়া থেকে আটকান। অবসাদগ্রস্ত একজন মানুষকে পাগলা গারদে ঠেলে দিলে, তার যে কী পরিণতি হতে পারে,সেকথা আপনার চাইতে আর কে বেশি ভালো জানবে!

এখন তো আপনার অনেক প্রতিপত্তি, পিসিমণিকে উদ্ধার করে যে কোন‌ও একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিন। টাকা পয়সার চিন্তা নেই সব দায় দায়িত্ব আমার। গোবিন্দদা আর তার বৌ- ই
সমস্ত দেখাশোনার ভার নেবে। আপনার এ্যাকআউন্ট নম্বরটা পেলেই আমি টাকা পাঠিয়ে দেব। তারপরেই না হয় আপনি কাজটা শুরু করবেন!
আমার আর গোবিন্দদাদার ফোন নং এই সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি…

জানি এই অপরাহ্ণবেলায়, প্রভাতকালে‌র ‌‌কোন‌ও কিছুই হয়তো আর অবশিষ্ট‌ নেই, তবু এককালে‌ তো ভালোবেসেছিলেন, সেই ভালোবাসার দোহাই……।

আবার আকাশ কালো করে তুমুল বৃষ্টি নেমেছে ,সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। বনষ্পতিগুলো,প্রবলবেগে বেগে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। দিব্যর মনেও মহাসমুদ্রের কলরোল। অতীতের ছেঁড়া পৃষ্ঠাটা উড়ে এসে আবার সব কিছু এলোমেলো করে দিলো।প্রবল বৃষ্টির ছাটে ভিজে যাচ্ছিলেন দিব্য।

“আসতে পারি?” —বারান্দায় একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিভাদেবী।

“আরে হ্যাঁ হ্যাঁ”—গলাটা স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টায়,সোজা হয়ে বসলেন‌ দিব্য।

“শরীরটা কি খারাপ? দুপুরে তো কিছুই প্রায় খেলেন না!”

” না না , একদম ঠিক আছি, ঐ একটা …” থেমে গেলেন দিব্য।

“তাহলে বুঝি মন খারাপ! একটু বসতে পারি?”

“আরে হ্যাঁ হ্যাঁ , কী আশ্চর্য…”

“বলছিলাম যে , মাসিমা বলে তো ডাকেন, দুঃখটা কি একটু ভাগ করে নেওয়া যায়!”

আর পারলেন না দিব্য। দরদী ছোঁয়ায়,এতো কালের চেপে রাখা পর্বতপ্রমাণ পাষাণভার, নামিয়ে হালকা হতে, এই প্রথমবার অকপট হলেন তিনি।

“এখন আমি কী করি?”

বাচ্চা ছেলেটি যেন মায়ের কোলে মুখ গুঁজেছে।

” এতো ভাবনার কী আছে ? আপনার কতো লোকবল। চটপট কাজে লেগে পড়ুন।পুলিশের ওপরমহলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, আইনজীবির পরামর্শ নিন, ফর্মালিটিস সেরে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে পরুন রাজকন্যা উদ্ধারে।”

ম্লান একটুকরো হাসি দেখা দিলো দিব্যর মুখে।

“কিন্তু ওকে এনে রাখবো কোথায়? যেখানে সেখানে তো আর তোলা যায় না। ভাড়া বাড়ি অথবা হোম জোগাড় করতেও তো সময় লাগে, তাছাড়া মানসিক অবস্থাও তো–“

” কেন হোমের কী দরকার! গৃহলক্ষ্মীকে তো ঘরেই প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এখন দেবীপক্ষ, ঘট স্থাপনের এটাই তো উপযুক্ত সময়!”

“মাসিমা!! “

“হ্যাঁ বাবা,আর দেরি নয়,কাজে লেগে প’রো। ছেলে,বৌমা নিয়ে ঘর করা আমার অনেক দিনের সাধ!”

আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলেন বিভাদেবী।

এরপর ঘটনার চাকা দ্রুত গড়ালো। দিন দুয়েক বাদে
একটু বেশী রাতে দিব্যর গাড়ি ছাড়াও পুলিশের গাড়িসহ আর‌ও খানদুই গাড়ি নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিলো। শত্রুকে অতর্কিতে আক্রমণ করাই রণনীতি। দূরে কোথাও ছাতিম ফুটেছে। বাতাসে ছাতিমের ভারী গন্ধ।
আবৃত্তিকার দিব্য আবার জেগে উঠছিলো বহুদিন পর … …
মনের ভিতরে হাজির হ’লো চেনা ক‌’টি লাইন—
“লক্ষ বছর পার করেছি আমি
তোমার হাতেও আদিম কালের শোক
অতীত জীবন মুহূর্তে আগামী
এবার কোথাও নতুন কিছু হোক।

আজ তাহলে বাঁচার‌ই গান জ্বালি…”

এইখানে এসে চিন্তাটা থমকে গেল দিব্যর।কমলিনীর মনে তো আজ‌ও সেই তরুণ দিব্যর‌ই বসবাস, এই দিব্যকে সে যদি চিনতে না পারে ? যদি অন্য কেউ ভেবে..!!
রাত পাড়ি দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে নির্জন রাস্তা দিয়ে।
দিব্যর মনে তোলপাড় প্রশ্ন
— সময়ের উজান কেউ কী কখন‌ও বাইতে পেরেছে!
অন্তরীক্ষে, অনন্তনক্ষত্রবীথি নিরুত্তর।

Loading

Leave A Comment